অর্ধেকের বেশি খেলাপি ঋণ ১৭ ব্যাংকে, ছয়টির অবস্থা ভয়াবহ

দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের সংকট আরও গভীর হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের প্রায় ৩৬ শতাংশই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে ১৭টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ৫০ শতাংশের বেশি। আর ছয়টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৯০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে, যা ব্যাংকিং ব্যবস্থার জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি হিসেবে দেখা হচ্ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে মোট ঋণস্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৩ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬ লাখ ৪৪ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা। এক বছর আগে, গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সব ব্যাংকের অবস্থা এক রকম নয়। সেপ্টেম্বর শেষে দেশের ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে ২৩টির খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশের নিচে রয়েছে। ১৩টি ব্যাংকের খেলাপি ১০ থেকে ২০ শতাংশের মধ্যে, ৮টি ব্যাংকের ২০ থেকে ৫০ শতাংশের মধ্যে থাকলেও ১৭টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫০ শতাংশের ওপরে উঠে গেছে।

চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের রিসার্চ ফেলো অর্থনীতিবিদ এম. হেলাল আহমেদ জনি বলেন, খেলাপি ঋণ বাড়তে দেওয়া কোনো অর্থনীতির জন্যই শুভ নয়। ব্যাংক খাতের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা জোরদার না হলে রাজনৈতিক সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে খেলাপি ঋণ আবারও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও কঠোর তদারকি নিশ্চিত করতে হবে।

তিনি বলেন, আগের সরকারের সময়ে ঋণের নামে বিপুল অর্থ ব্যাংক খাত থেকে বের করা হয়, যার বড় অংশ বিদেশে পাচার হয়েছে। নানা নীতি সহায়তা ও পুনঃতফসিলের মাধ্যমে দীর্ঘদিন এসব ঋণ নিয়মিত দেখানো হয়েছিল। আগের দেওয়া সেই সুযোগ বন্ধ হওয়ায় প্রকৃত চিত্র সামনে আসছে এবং দ্রুত বাড়ছে খেলাপি ঋণ।

৯০ শতাংশের বেশি খেলাপি ছয় ব্যাংক
৯০ শতাংশের বেশি খেলাপি ঋণ থাকা ব্যাংকের তালিকায় রয়েছে ছয়টি ব্যাংক। এর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় বিদেশি মালিকানাধীন ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান। ব্যাংকটির ১ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ৯৯ দশমিক ৮৪ শতাংশই খেলাপি।

এ ছাড়া ইউনিয়ন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২৭ হাজার ১১৩ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৯৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ৫৯ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা বা ৯৬ দশমিক ২০ শতাংশ। গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ১৪ হাজার ১৪ কোটি টাকা বা ৯৫ দশমিক ৭০ শতাংশ ঋণ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। পদ্মা ব্যাংকের খেলাপির হার ৯৪ দশমিক ১৭ শতাংশ এবং আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের ৯১ দশমিক ৩৮ শতাংশ।

বেসরকারি ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের চিত্র
বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে খেলাপি ঋণের শীর্ষে রয়েছে এবি ব্যাংক। ব্যাংকটির ৩০ হাজার ১৩৬ কোটি টাকা বা ৮৪ দশমিক ০৪ শতাংশ ঋণ খেলাপি। ন্যাশনাল ব্যাংকের খেলাপি ৩২ হাজার ৪০ কোটি টাকা বা ৭৫ দশমিক ৪৬ শতাংশ। বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের খেলাপি ৭১ দশমিক ১১ শতাংশ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৭০ দশমিক ১৭ শতাংশ এবং আইএফআইসি ব্যাংকের ৬০ দশমিক ৬৩ শতাংশ। এক্সিম ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ৫৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ। এছাড়া ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৬ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৫৮ দশমিক ২৪ শতাংশ।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে জনতা ব্যাংকে। সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ৭০ হাজার ৬৭১ কোটি টাকা বা ৭৩ দশমিক ১৮ শতাংশ। বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ৭০ দশমিক ৫৯ শতাংশ, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের ৫২ দশমিক ৪৬ শতাংশ এবং রূপালী ব্যাংকের ৫১ দশমিক ১৯ শতাংশ।

খারাপ অবস্থায় পড়া শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোকে ঘুরে দাঁড় করাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক উদ্যোগ নিয়েছে। প্রাথমিকভাবে পাঁচটি ইসলামী ব্যাংক একীভূত করে ‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক’ গঠনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এই ব্যাংকগুলো হলো— এক্সিম ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক।

পাঠকের মন্তব্য