ট্রেনের টিকিট শেষ দুই মিনিটেই, এ কেমন ডিজিটাল সমাধান? - ড. বি এম মইনুল হোসেন

ঢাকা থেকে কক্সবাজারে যাবেন। যাত্রার ১০ দিন আগে ট্রেনের টিকিট অনলাইনে পাওয়া যাবে। অ্যাপ বা ব্রাউজারে সকাল আটটায় লগইন করতে গিয়ে দেখা যাবে ‘সার্ভার এরর’। কয়েকবারের চেষ্টায় যদি ঢুকতেও পারেন, বার্থ বা এসি সিটের টিকিট কয়েক মিনিটের মধ্যে শেষ। বিশেষ করে বিভিন্ন ছুটি বা উৎসবের মৌসুমে তো এটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।

প্রথম দুই মিনিটের মধ্যে যদি এত মানুষ সার্ভারে হিট করে, সারা দিন মাছি মারা কেরানির ভূমিকায় থাকলেও সকাল আটটার সময় সার্ভার এত এত ব্যবহারকারী সামলাতে পারবে না, সেটাই স্বাভাবিক। এটি সার্ভারের কোনো ‘এরর’ নয়, বরং প্রত্যাশিত ফলাফল। কিছু একটা এদিক–সেদিক হলে সে দোষ সার্ভারের ওপর বর্তানোর একটা সংস্কৃতি শুরু হয়ে গেছে। সার্ভার একসঙ্গে কতজন ব্যবহারকারীকে সেবা দিতে পারবে, তার একটি সীমা আছে। সেটির বেশি ব্যবহারকারী হলে সার্ভার কাজ করার কথা নয়। ফলে এটা সার্ভারের ত্রুটি নয়, স্বাভাবিক আচরণ।

দেশে কয়টা স্থান আছে, যেখানে মানুষ বেড়াতে যায়, অবকাশ যাপনে যায়? হাতে গোনা কয়েকটাই তো হবে। তার মধ্যে কক্সবাজার একটি। চারটির বেশি ট্রেন টিকিট কেনা যাবে না একটি পরিচয়পত্র দিয়ে।

বুঝলাম, আমাদের নানা সীমাবদ্ধতার কারণে এসব নিয়ম আনতে হয়। কিন্তু কেউ যদি পরিবারের সব সদস্য বা বন্ধুবান্ধবসহ কক্সবাজারের মতো একটা গন্তব্যে বেড়াতে যান, তাহলে প্রথমেই ট্রেনে যাওয়ার পরিকল্পনা বাদ দিতে হবে। কারণ, খুব স্বাভাবিকভাবেই মানুষ চাইবে পরিবারের সবাই একসঙ্গে পাশাপাশি ভ্রমণ করতে। নতুন আরও আইডি কার্ড দিয়ে বুকিং দিতে গেলে হয়তো আর পাশাপাশি সিট পাওয়া যাবে না।

এ জায়গায় ডিজিটাল সিস্টেম এনে সমস্যা সমাধান না করে সমস্যা সৃষ্টি করছেন। এর মাধ্যমে বাধ্য করছেন ট্রেনের টিকিট না কেটে অন্য মাধ্যমে ভ্রমণ করতে। যদিও সমস্যাটি ডিজিটাল হওয়ার কারণে নয়, সমস্যাটি উপযুক্ত নীতিমালার অভাবে। হয়তো সহজ সমাধান হতে পারে, একসঙ্গে যত খুশি পাশাপাশি টিকিট বুকিং দেওয়া, কিন্তু সংখ্যানুপাতে একাধিক পরিচয়পত্র ব্যবহার করে টিকিট কনফার্ম করা।

আবার অনলাইন টিকিট কাটার মাধ্যমে টিকিট কালোবাজারি করার যে সমস্যা সমাধান করার কথা বলা হয়ে থাকে, সেটিও আসলে অকার্যকর। সাধারণত ১০ দিন আগে ট্রেনের টিকিট কাটা যায়। টিকিট বিক্রি হওয়ার জন্য ওয়েবসাইট ওপেন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইচ্ছা করলে কোনো চক্রের সবাই মিলে জনপ্রতি চারটি করে টিকিট কিনে ফেলতে পারে।

রেলওয়ের রিফান্ড পলিসি অনুযায়ী, ৪৮ ঘণ্টা আগে রিফান্ড করলে ৯০ শতাংশ টাকাই ফেরত পাওয়া যায়। অর্থাৎ আগে থেকে বুকিং করে রাখা টিকিট বেশি দামে বিক্রির সুযোগ তো থাকছেই, কোনো কারণে বিক্রি না হলে রিফান্ড তো পাওয়া যাবেই।

তাহলে কালোবাজারি সমস্যার সমাধান কি আসলে হলো, নাকি সমস্যার শুধু ডিজিটাল রূপান্তর ঘটল?

আদর্শ সমাধান হতে পারত, উপাত্তভিত্তিক সিদ্ধান্ত (ডেটা-ড্রাইভেন ডিসিশন) কার্যকর করা গেলে। অর্থাৎ টিকিটের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে বগি বাড়ানো বা কমানো সম্ভব হলে। তাহলে টিকিট শেষ হয়ে গেছে বলে কাউকে কালোবাজারে চেষ্টা করতে হতো না, টিকিট বিক্রি হয়নি বলে খালি বগি নিয়ে ট্রেনকেও ছুটে চলতে হতো না। যদিও সে প্রক্রিয়ার বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। ইঞ্জিনের স্বল্পতাসহ নানা ব্যবস্থাপনাগত জটিলতার কারণে সেটি বাস্তবায়ন করা কঠিন। কিন্তু তাই বলে ডিজিটাল টিকিটের নামে সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে মনে করারও কোনো কারণ নেই।

ডিজিটাল হওয়া মানেই সমস্যার সমাধান হওয়া নয়। আমাদের রেগুলার ট্রাফিক সিস্টেম ঠিক না করে আমরা যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক ট্রাফিক সিস্টেম নাম দিয়ে সমাধান খুঁজতে যাই, সেটাতে ট্রাফিক সমস্যার সমাধান তো হবেই না, বরং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাই সমস্যায় পড়ে যাবে।

তথ্যপ্রযুক্তি কোনো জাদুর বাক্স নয়। কম্পিউটার কিছু সমাধান করে না, সমাধান মানুষ করে। কম্পিউটার কাজগুলোকে দ্রুত, সহজলভ্য, সহজবোধ্য করে, সমস্যা সমাধানের উদ্ভাবনী পন্থার সুযোগ তৈরি করে। কিন্তু দিন শেষে সমস্যা সমাধান করার দায়িত্ব মানুষেরই।

কাক চোখ বন্ধ করে ভাবে, আশপাশে কেউ তাকে দেখছে না। আমরা মূল সমস্যায় না গিয়ে চোখ বন্ধ করে জোড়াতালির ডিজিটাল সিস্টেম তৈরি করে যদি ভাবতে থাকি, সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে, তাহলে সমস্যার সমাধান তো হবেই না, বরং ‘ডিজিটাল’ শব্দটিই উপহাসে পরিণত হবে। সে রকম কিছু নিদর্শন ইতিমধ্যে তৈরিও হয়ে গেছে।

ইউনিয়ন পরিষদ অফিস বা ইউনিয়ন ভূমি অফিসের ডিজিটাল পরিষেবার ব্যাপারে মানুষের অভিমত কী, সেটি নিয়ে একটু খোঁজখবর করলেই প্রকৃত দৃশ্য ফুটে উঠবে। লোকজন ঠাট্টা করে বলে, আগে শুধু সাহেবের জন্য কিছু দিলেই হতো, এখন সাহেবের সঙ্গে সার্ভারের মেজাজ-মর্জি ঠিক রাখার জন্যও কিছু দিতে হয়।

লেখক: ড. বি এম মইনুল হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও পরিচালক।

bmmainul@du.ac.bd

 

পাঠকের মন্তব্য