ঢাবিতে ওয়ার্ল্ড ডেমোক্রেসি কংগ্রেস অনুষ্ঠিত

বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ওপর দুই দিনব্যাপী প্রথম আন্তর্জাতিক আন্তঃবিভাগীয় ‘ওয়ার্ল্ড ডেমোক্রেসি কংগ্রেস’ অনুষ্ঠিত হয়েছে। পলিটিক্যাল অ্যান্ড পলিসি সায়েন্স রিসার্চ ফাউন্ডেশন (পিপিএসআরএফ) এই কনফারেন্সের আয়োজন করে।

মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) সকাল ৯টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান ভবনের মোজাফফর আহমদ চৌধুরী মিলনায়তনে শুরু হয়ে শেষ দিনের অধিবেশন শেষ হয় সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায়।

কনফারেন্সের আহ্বায়ক পিপিএসআরএফের চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বক্তব্যের শুরুতেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ইন্তেকালে ওয়ার্ল্ড ডেমোক্রেসি কংগ্রেসের পক্ষে শোক জ্ঞাপন করেন। এসময় বেগম খালেদা জিয়ার রুহের মাগফেরাত কামনায় দোয়া ও মোনাজাত করা হয়। মোনাজাত পরিচালনা করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক তারেক ফজল।

কনফারেন্সের কি-নোট স্পিকার বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক রওনক জাহান বলেন, আমি নিজ চোখে মাঠপর্যায়ে যা দেখেছি তার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে আমার রাজনৈতিক মূল্যবোধ ও উপলব্ধি গড়ে উঠেছে। তাত্ত্বিক জ্ঞানের কোনো অংশ গ্রহণযোগ্য আর কোনো তাত্ত্বিক ধারণা প্রত্যাখ্যান করা প্রয়োজন, মানুষের কথা শোনা ও বাস্তব অভিজ্ঞতা আমাকে তা বিচার করতে শিখিয়েছে।

তিনি বলেন, যদি আমরা রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকার দিকে তাকাই, তাহলে আমার মনে হয়– এ মুহূর্তে আমাদের যেটা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তা হলো সব পক্ষের জন্যই আত্মপর্যালোচনা। যদিও এই অধিবেশনটি রাজনীতি নিয়ে, তবুও আমি মনে করি এটি সবার জন্যই নিজের দিকে ফিরে তাকানোর সময়– কেন বাংলাদেশে আমরা বারবার এমন এক ধরনের ক্ষুদ্র যাত্রার মধ্য দিয়ে যাই এবং তারপর আবার পিছিয়ে পড়ি। এখানে প্রত্যেকটি পক্ষের ভূমিকা কী ছিল, কোথায় আমরা ব্যর্থ হয়েছি– সেটা ভেবে দেখার সময় এসেছে।

এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আরও বলেন, আমার মনে হয়, সব সময় অন্যের ওপর দোষ চাপানো, নানা ধরনের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ছড়ানো এবং কোনো সমালোচনা মন দিয়ে না শোনা– এগুলো আমাদের বড় সমস্যার জায়গা। তাই আমি মনে করি, বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য এখন আত্মসমালোচনার সময় এসেছে।

এ দিন সকালের একটি ফিচার অধিবেশনে ও বিকেলের একটি ফিচার অধিবেশনে ফিচার স্পিকার ও সম্মানিত অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন যথাক্রমে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল আহসান ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এ এস এম আমানুল্লাহ।

সমাপনী পর্বে সম্মানিত অতিথি ও ফিচার স্পিকার হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সদ্য সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান, সুজনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত নরওয়ের রাষ্ট্রদূত হাকন আরালদ গুলব্রান্ডসন।

বদিউল আলম মজুমদার বলেন, গণতন্ত্রের সংকটের জন্য শুধু সরকারকে দায়ী করলে চলবে না; নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমকেও নিজেদের ভূমিকা নিয়ে আত্মসমালোচনা করতে হবে। অতীতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ব্যক্তি ও জনস্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের প্রমাণ। তবে গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে হলে সংস্কার, ঐকমত্য এবং জবাবদিহিমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলাই একমাত্র পথ– শুধু নির্বাচন নয়, কার্যকর গণতান্ত্রিক চর্চাই প্রকৃত উত্তরণের শর্ত।

মতিউর রহমান বলেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র আজ গভীর সংকটে। একসময় সংবাদপত্র ও সিভিল সোসাইটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের শক্ত ভিত্তি ছিল, কিন্তু এখন তারা দুর্বল ও আক্রমণের মুখে। স্বাধীন গণমাধ্যম বারবার চাপ, দমন ও সহিংসতার শিকার হচ্ছে, যা গণতন্ত্রের জন্য বড় হুমকি।

তিনি বলেন, তরুণ ও ছাত্রদের আন্দোলন পরিবর্তনের আশা জাগালেও স্পষ্ট নেতৃত্ব ও সংগঠনের অভাবে সেই সম্ভাবনা ঝুঁকিতে পড়েছে। গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান, সক্রিয় নাগরিক সমাজ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ– একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন প্রয়োজন। সব প্রতিকূলতার মধ্যেও আমরা বিশ্বাস করি, সহনশীল ও অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।

কনফারেন্সের আহ্বায়ক অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ওয়ার্ল্ড ডেমোক্রেসি কংগ্রেসে আপনাদের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে এই আয়োজনকে অর্থবহ ও সফল করে তোলার জন্য আমি আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। বিভিন্ন দেশ ও প্রেক্ষাপট থেকে আগত চিন্তাবিদ, নীতিনির্ধারক, গবেষক এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের অভিজ্ঞতা ও বিশ্লেষণ আমাদের গণতন্ত্র বিষয়ে ভাবনাকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। বাংলাদেশ আজ একটি গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক উত্তরণপর্ব অতিক্রম করছে। এই প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, বিশেষ করে নরওয়ের মতো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে দৃঢ় বিশ্বাসী রাষ্ট্রের সঙ্গে অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান বিনিময় অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। আমরা আশাবাদী যে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান শক্তিশালীকরণে নরওয়ের সঙ্গে ভবিষ্যতেও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার সুযোগ আরও সম্প্রসারিত হবে।

তিনি আরও বলেন, একইসঙ্গে সুজনের মতো সংগঠনের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে গণতন্ত্র, জবাবদিহিতা ও নাগরিক অংশগ্রহণ জোরদারে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। রাষ্ট্র, নাগরিক সমাজ ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সম্মিলিত প্রয়াসই টেকসই গণতন্ত্রের পথ সুগম করতে পারে– এই বিশ্বাস থেকেই আমাদের এই যাত্রা।

কনফারেন্সের সমাপনী বক্তা সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলেন, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ভাষা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রাম– সব আন্দোলনের শহীদরা আমাদের প্রেরণা। একইভাবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্রসফায়ার, গুম, মিথ্যা মামলা ও গুলিতে নিহত বা পঙ্গু মানুষের আত্মত্যাগও আমাদের বিবেককে নাড়া দেয়।

তিনি বলেন, এই সব ত্যাগকে সঙ্গে নিয়ে যদি আমরা গণতন্ত্রের পথে অবিচল থাকি, তবেই একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়া সম্ভব। ব্যর্থ হলে আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে দায়ী থাকব। আমরা এমন বাংলাদেশ চাই, যেখানে মতপ্রকাশ দমনে আগুন বা গুলি নয়, ন্যায়বিচার ও সহনশীলতা থাকবে; যেখানে সংখ্যালঘু নির্যাতন, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার জায়গা নেই। একটি মানবিক, সহনশীল ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার এই পথেই আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই।

একই ভেন্যুতে সোমবার (২৯ ডিসেম্বর) প্রথম দিনের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। কনফারেন্সে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, অধ্যাপক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও সংবাদমাধ্যমের সম্পাদকরা ফিচার স্পিকার ও আলোচক হিসেবে অংশগ্রহণ করেন।

আয়োজকরা জানান, সম্মেলনের জন্য জমা পড়া প্রায় ১৬৫টি গবেষণাপত্রের মধ্য থেকে বাছাই করে ৬৭টি প্রবন্ধ উপস্থাপনের জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে। এতে অনলাইনে প্রায় ২০টি দেশের প্রতিনিধি অংশ নেন এবং বিশ্বের প্রায় ৩৫টি দেশ এই সম্মেলনের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করে।

পাঠকের মন্তব্য