ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে ভাঙছে বহু পরিবার

শ্রীনগরের এক সরু গলির নিস্তব্ধতা ভেঙে যায় হকারদের হাঁকডাক ও ছোট দুই শিশুর কান্নায়। ‘খালা, আমাকে আমার মায়ের কাছে নিয়ে যান, পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে গেছে’– এভাবে চিৎকার করছিল তিন বছরের হুসাইন। দুই বছর বয়সী ছোট বোন নুরি তাকে জড়িয়ে ধরে জানালার লোহার গ্রিল চেপে ধরে কাঁদতে থাকে। 

তাদের বাবা মজিদ বলেন, তাদের মা সামিনা পাকিস্তানের নাগরিক। সাত মাস আগে ভারতের পুলিশ তাকে জোর করে ধরে নিয়ে পাকিস্তানে ফেরত পাঠিয়েছে। তখন থেকেই ছেলে-মেয়ে দুটি এভাবে সবাইকে ডেকে মায়ের কথা বলে। 

গত ২২ এপ্রিল ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পর্যটন এলাকা পেহেলগামে বন্দুকধারীরা হামলা চালিয়ে ২৬ জনকে হত্যা করে। ভারতের ভাষ্য, হামলাকারীদের কয়েকজন পাকিস্তানি ছিল। এর পরই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই কাশ্মীরকে ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশই নিজেদের বলে দাবি করে। 

পেহেলগাম হামলার পর ভারতের কঠোর সিদ্ধান্ত 
হামলার পর ভারত পাকিস্তানকে দায়ী করে সব দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক কমিয়ে দেয়, বাণিজ্য বন্ধ করে, পানি চুক্তিও স্থগিত করে। দুই সপ্তাহ পর দুই দেশের মধ্যে চার দিনের বিমানযুদ্ধ হয়, বহু মানুষ মারা যায়। পরে দেশ দুটি অস্ত্রবিরতিতে সম্মত হয়। কিন্তু সাত মাস পরও শত শত পরিবার আলাদা হয়ে আছে। 

ভারত সব পাকিস্তানি ভিসা বাতিল করে গত ২৯ এপ্রিলের মধ্যে দেশ ছাড়ার নির্দেশ দেয়। ১ মে ওয়াঘা সীমান্তও বন্ধ করে দেয়। প্রায় ৮০০ পাকিস্তানিকে দেশ থেকে বের করে দেওয়া হয়, যাদের অনেকেই ভারতীয়দের সঙ্গে বিবাহিত ছিলেন। 

মজিদ ২০১৮ সালে তাঁর পাকিস্তানি আত্মীয় সামিনাকে বিয়ে করেন। দেশ দুটির সম্পর্ক খারাপ হলেও এমন বিয়ে অস্বাভাবিক নয়। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর দুই দেশের অনেক পরিবারই বিভক্ত হয়ে পড়ে। ২৮ এপ্রিল পুলিশ সামিনাকে থানায় ডেকে পাঠায়। বাচ্চারা তখন ঘুমিয়ে ছিল। পরে বাচ্চারা জেগে দেখে, বাবা আছে; কিন্তু মা নেই। সামিনাকে জানানো হয়, পরদিনই তাঁকে পাকিস্তানে ফেরত পাঠানো হবে। তিনি লাহোরের বাসিন্দা। শিশুদের একা রেখে মজিদ এখন ঘরের বাইরে যেতে পারেন না, কাজও করতে পারেন না। মজিদ বলেন, ছয় মাস ঠিকমতো ঘুমাইনি। সব সময় বাচ্চাদের দেখছি। কখনও কখনও মনে হয় জীবনটাই শেষ করে দিই। কিন্তু বাচ্চাদের কথা ভেবে থেমে যাই। আবার পাকিস্তানে সামিনার স্বাস্থ্যের অবস্থাও খারাপ। তার রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে নেই, নিয়মিত হাসপাতালে যেতে হচ্ছে। 

ভারতীয় সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, পাকিস্তানি নাগরিকরা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি। এ জন্য তাদের ফেরত পাঠানো হয়েছে। ফজল-উর-রহমান (৬২) বলেন, তাঁর স্ত্রী পারভিনাকে গত এপ্রিলে পাকিস্তানে পাঠানো হয়েছে। অথচ গত ৪০ বছর ধরে তিনি পাকিস্তানে যাননি। ১৯৮২ সাল থেকে তিনি কাশ্মীরেই থাকতেন। 

তাদের মেয়ে সোলিহা পড়াশোনা ছেড়ে বাড়ির দায়িত্ব নিয়েছে। তার মা হৃদরোগে ভুগছেন, পাকিস্তানে চিকিৎসার সামর্থ্যও নেই। তিনি এখন করাচিতে এক দূর সম্পর্কের অসহায় আত্মীয়ের সঙ্গে থাকছেন। সোলিহা প্রশ্ন তোলেন, ‘অপরাধ করেছে অন্যরা। তার জন্য আমাদের কেন শাস্তি পেতে হবে?’ 

আইন বিশেষজ্ঞ কলিন গনসালভেস বলেন, ‘যাদের ফেরত পাঠানো হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগই প্রমাণিত নয়। শুধু পাকিস্তানি ও মুসলিম হওয়ার কারণেই এমনটা করা হয়েছে।’ আলজাজিরা।

পাঠকের মন্তব্য