আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ছিলেন এমনি এক অসাধারণ মহাপুরুষ

লেখক: বোরহানউদ্দিন চৌধুরী মুরাদ

মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় পাথরঘাটাস্থ জুপিটার হাউজ থেকে সংগ্রাম কমিটির কর্মকান্ড পরিচালিত  হত। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা চট্টগ্রামে আসার পর জুপিটার হাউজ থেকে সাইক্লোস্টাইল করে প্রচার করা হয়। তাঁর বাসা থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রসহ সব জায়গায় পাঠানো হয়। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ভারতে গমন করেন  এবং সেখানে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মুজিবনগর সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটির সদস্য ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন, বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠন ছিলো তাঁর মূল লক্ষ্য।

রাজনীতিতেই নয়, আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু একজন সফল ব্যবসায়ী ও শিল্পদ্যোক্তা ছিলেন। স্বাধীনতার পূর্বে তিনি বাটালী রোডে রয়েল ইন্ডাস্ট্রি নামে একটি কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। একই সাথে তিনি বড় ভাইয়ের কারখানাগুলোও দেখাশোনা করতেন। পরবর্তীতে আখতারুজ্জামান বাবু আসিফ স্টিল মিল, জাভেদ স্টিল মিল, আসিফ সিনথেটিক, প্যান আম বনস্পতি, আফরোজা অয়েল মিল, বেঙ্গল সিথেটিক প্রোডাক্ট ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন। ভ্যানগার্ড স্টিল মিল, সিনথেটিক রেজিন প্রোডাক্ট ক্রয় করে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের প্রথম দু’দশকে জামান শিল্পগোষ্টির গোড়াপত্তন করেন। তিনি বিদেশী মালিকানাধীন আরামিট মিল ক্রয় করে সেটিকে সুদৃঢ় ভিত্তিক উপর দাঁড় করান। বাংলাদেশে বেসরকারি ব্যাংকিং সেক্টর প্রতিষ্ঠায় তিনি পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন। তিনি দেশে দ্বিতীয় প্রাইভেট ব্যাংক ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড (ইউসিবিএল) এর উদ্যোক্তা এবং প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন। 
আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু দেশের ব্যবসায়ী সমাজের মুখপাত্র ও ব্যবসায়ী নেতা হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

১৯৪৫ সালে আনোয়ারা হাইলধর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। তাঁর পিতার নাম নুরুজ্জামান চৌধুরী। তিনি ছিলেন আইনজীবী এবং জমিদার। তাঁর মাতার নাম খোরশেদা বেগম। তিনি বাংলাদেশের স্বনামধন্য শিল্পপতি, চট্টগ্রামের বোয়ালখালির জমিদার ইসলাম চৌধুরীর কন্যা নুর নাহার জামানের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি ব্যক্তি জীবনে ৩ পুত্র ও ৩ কন্যা সন্তানের জনক। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ১৯৫৮ সালে পটিয়া হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে এই বছরই ঢাকা নটরডেম কলেজে ভর্তি হন। ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে পড়ার সময় তিনি বৃত্তি পেয়ে আমেরিকার ইলিনয় ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজিতে ভর্তি হন। পরে তিনি নিউইয়র্ক ইউনিভর্সিটিতে বিজনেস এডমিটিস্ট্রেশনে পড়াশোনা করেন। 

সেখান থেকে এসোসিয়েট ডিগ্রি নিয়ে ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বরে দেশে ফিরেন। ১৯৬৫ সালে তিনি বড় ভাইয়ের সাথে ব্যবসায় যোগ দেন। এছাড়া দেশে থাকা অবস্থায় ১৯৫৮ সালে দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সদস্য নির্বাচিত হন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। এরপর দেশে ফিরে আবার ১৯৬৭ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সাথে তাঁর পথ চলা শুরু। ৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি আনোয়ারা ও পশ্চিম পটিয়া থেকে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। চট্টগ্রামের রাজনীতিতে তিনি প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। দীর্ঘ সময় ধরে ছিলেন দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। জাতীয় সংসদ সদস্য চারবার নির্বাচিত হবার পাশাপাশিও ছিলেন আওয়ামীলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য। নবম জাতীয় সংসদে তিনি ছিলেন পাট বস্ত্র মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত— সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি। 

মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি তিনি প্রথম লন্ডনে যান সেখান থেকে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সদস্য হয়ে আমেরিকায় যান। ১৯৭০ সালের প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য (এমপিএ) হিসেবে আখতারুজ্জামান চৌধুরী ১৯৭২ সালে গঠিত বাংলাদেশ গণ পরিষদের সদস্য হন এবং বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে ভূমিকা রাখেন। স্বাধীনতার  পর ১৯৮৬, ১৯৯১ এবং ২০০৮ সালে তিনি জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। স্বাধীনতার  পর আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রিয় শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। ১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু খুন হবার পর আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের সাথে যোগাযোগ করেন এবং পরবর্তীতে দলের পুনরজ্জীবন ও পুনর্গঠনে সাহসী ভূমিকা পালন করেন। আশির দশকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনেও আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। 

স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি কারা নির্যাতন ভোগ করেন। তিনি দু-দফায় চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ১৯৮৮ সালে তিনি দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠক এফবিসিসিআইর প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ওআইসিভুক্ত দেশসমুহের চেম্বারের প্রেসিডেন্ট হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৯ সালে তিনি ৭৭ জাতি গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনিই একমাত্র বাংলাদেশী যিনি এই মর্যাদাপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংস্থার ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু একজন সমাজহিতৈষী, দানবীর ও জনদরদী ছিলেন। ১৯৬৭ সাল থেকে ৭৫ সাল পর্যন্ত— তিনি হাইলধর ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন। স্বাধীনতার পরেও তিনি হাইলধর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং থানা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। আনোয়ারা ডিগ্রী কলেজ, যোগেশ চন্দ্র মেমোরিয়াল ট্রাস্ট, হাইলধর বীশরুজ্জামান উচ্চ বিদ্যালয়, বরুমচড়া, বশরুজ্জামান উচ্চ বিদ্যালয় ও ঝিবাশি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতাসহ বটতলী মোহছেন আউলিয়া ডিগ্রী কলেজ, চন্দনাইশ বরমা কলেজ, এনায়েত বাজার মহিলা কলেজ, এ.জে.চৌধুরী ডিগ্রী কলেজ, রায়পুর উপকূলীয় উচ্চ বিদ্যালয়সহ আনোয়ারা পশ্চিম পটিয়ার ও চট্টগ্রামে অনেক স্কুল কলেজের প্রতিষ্ঠাতাদাতা সদস্য। এছাড়াও বহু জনহিতকর কাজের সাথে জড়িত ছিলেন তিনি।

আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর মত এত বড় মাপের মহৎ হৃদয়বান জাতীয় নেতার সহচার্য লাভের যার সুযোগ হয়েছে, সেই সৌভাগ্যবান। বিশ্বস্ততার সহিত মৃত্যুর আগ পর্যন্ত— আমরা যারা তাঁর অভিভাবকত্বে তাঁর সহিত রাষ্ট্রের সেবামূলক কাজ করেছি এবং তাঁর সেবা করার সুযোগ পেয়েছি। তাঁকে কাছ দেখেছি, মিশেছি। সুখ, দুঃখের সঙ্গী হয়েছি। আমরা দেখেছি, তাঁর মধ্যে এক নরম প্রকৃতির হৃদয়, মানুষকে ভালবাসার উদার মন-মানসিকতা। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু সমস্ত লোভ-লালসার উর্ধ্বে উঠে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ নির্মাণের সম্মুখ সৈনিক ছিলেন। 

তিনি স্বাধীনতা উত্তর কালের সেই সব বিরল রাজনীতিবিদে অন্যতম যারা আওয়ামীলীগের দুঃসময়ে হাল ধরেছেন, রাজনীতি করেছেন নিজের অর্থ ব্যয় করে, বর্ষিয়ান এই আওয়ামীলীগ নেতা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ছিল এমনি এক অসাধারণ মহাপুরুষ। যার সঙ্গে সঙ্গে চলে গেছে বিশাল এক প্রাণবন্ত জগত। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে ২০২১ সালে মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু স্বাধীনতা পদক (মরণোত্তর) অর্জন করেন। 
 

পাঠকের মন্তব্য