প্রকৌশল খাতে বৈষম্যের মহোৎসব : বিএসসি ডিগ্রিধারীরা কি তবে পরিত্যাজ্য?
-
- - নিজস্ব -
- প্রতিবেদক --
- ২৩ অগাস্ট, ২০২৫
বাংলাদেশের প্রকৌশল খাত আজ এক অভূতপূর্ব সংকটে। দেশের শীর্ষ মেধাবীরা যেখানে দীর্ঘ চার বছর কঠোর পরিশ্রম করে বুয়েট, কুয়েট, রুয়েট, চুয়েটসহ স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকৌশল ডিগ্রি অর্জন করছেন, সেখানে তাদের ন্যায্য অধিকার আজ ডিপ্লোমাধারীদের সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি।
একদিকে এসএসসি পাশের পর চার বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা অর্জনকারীরা উপসহকারী প্রকৌশলী পদে ১০০% কোটা দখল করে বসে আছেন, অন্যদিকে বিএসসি ডিগ্রিধারী প্রকৌশলীরা একই পদে আবেদন করার ন্যূনতম সুযোগ থেকেও বঞ্চিত।
প্রশ্ন জাগে—যেখানে সরকারি চাকরির অধিকাংশ দশম গ্রেডে ন্যূনতম যোগ্যতা স্নাতক ডিগ্রি, সেখানে কেবল ইঞ্জিনিয়ারিং সেক্টরেই কেন এই বৈষম্য?
প্রকৌশলী মহলে অভিযোগ, ১৯৯৪ সাল থেকে শুরু হওয়া ডিপ্লোমাধারীদের আন্দোলনের মাধ্যমে ধাপে ধাপে দখল করা হয়েছে প্রকৌশলীদের কর্মক্ষেত্র। দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা আদায় থেকে শুরু করে ২০১৩ সালে সহকারী প্রকৌশলী পদের দখল—সবই হয়েছে আন্দোলন, চাপ আর বিশৃঙ্খলার মাধ্যমে। আজকের চিত্র আরও ভয়াবহ:
দশম গ্রেডে ১০০% কোটা ডিপ্লোমাধারীদের হাতে।
নবম গ্রেড সহকারী প্রকৌশলীর পদে ৩৩% থেকে শুরু করে ৬৭% পর্যন্ত প্রমোশন কোটার দখল।
অনেক প্রতিষ্ঠানে সরাসরি নিয়োগ প্রায় শূন্যের কোঠায়।
প্রমোশনের নামে অবৈধভাবে ডিপ্লোমাধারীরা বিসিএস ক্যাডার পর্যন্ত হয়ে যাচ্ছেন।
এমনকি দেখা যাচ্ছে, একই বছরে চাকরিতে যোগ দেওয়া সত্ত্বেও ডিপ্লোমাধারীদের সিনিয়রিটি জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয় বিএসসি প্রকৌশলীদের চাপে রাখার জন্য। এর ফলে প্রকৃত যোগ্যতা সম্পন্ন প্রকৌশলীরা পদোন্নতির সুযোগ হারাচ্ছেন, অনেকেই হতাশ হয়ে সাধারণ ব্যাংক চাকরি বা বিদেশে পাড়ি জমাতে বাধ্য হচ্ছেন।
প্রকৌশল খাতে নৈরাজ্যের নমুনা
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরে সহকারী প্রকৌশলীর মোট ২৪৫টি পদে বর্তমানে কর্মরত আছেন ডিপ্লোমাধারী ১৬০ জন, অথচ বিএসসি প্রকৌশলী মাত্র ৬৩ জন।
গণপূর্ত অধিদপ্তরে প্রমোশনের নির্ধারিত ৩৩% সীমা ভেঙে ৪২% পদ ডিপ্লোমাধারীরা দখল করেছেন।
অনেক সময় “ভারপ্রাপ্ত” বা “চলতি দায়িত্ব” নামে পদোন্নতি দিয়ে কয়েক মাস পরই সেটিকে স্থায়ী করা হয়, যাতে নবম গ্রেডে বিএসসি প্রকৌশলীদের প্রবেশপথ একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্ষোভ ও হতাশা
বুয়েট, কুয়েট, রুয়েট, চুয়েট ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বছরের পর বছর ধরে এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করলেও কার্যত কোনো পরিবর্তন হয়নি। শিক্ষার্থীদের ক্ষোভের জ্বালামুখ আজ জাতীয় সংকটে রূপ নিয়েছে।
তাদের দাবি একটাই—
১. সহকারী প্রকৌশলী (নবম গ্রেড) পদে প্রবেশের একমাত্র যোগ্যতা হতে হবে বিএসসি ডিগ্রি এবং সবার জন্য সমান নিয়োগ পরীক্ষা।
২. দশম গ্রেড উপসহকারী প্রকৌশলী পদে ১০০% কোটা বাতিল করে সেখানে ডিপ্লোমা ও উচ্চতর ডিগ্রিধারী উভয়ের আবেদন করার সুযোগ দিতে হবে।
৩. ‘Engineer’ টাইটেল কেবল বিএসসি ডিগ্রিধারীদের জন্য সংরক্ষিত রাখতে হবে—আইন করে এ বিষয়ে শাস্তির বিধান থাকতে হবে।
বাংলাদেশের কোনো পেশায় এ রকম নজির নেই। চিকিৎসক হতে হলে অবশ্যই এমবিবিএস, আইনজীবী হতে হলে অবশ্যই এলএলবি, চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট হতে হলে নির্দিষ্ট কোর্স—এখানে কোনো শর্টকাট নেই। কিন্তু কেবল ইঞ্জিনিয়ারিং পেশাতেই স্নাতক ডিগ্রিধারীদের ওপর অবৈধভাবে ডিপ্লোমাধারীদের সিন্ডিকেট চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।
সরকারের প্রতি প্রশ্ন
যদি দেশের প্রকৌশল খাত বিএসসি প্রকৌশলীদের জন্য না-ই হয়, তবে কি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ করে শুধু পলিটেকনিকই চালু রাখাই যুক্তিযুক্ত?
প্রকৌশলী অধিকার আন্দোলনের নেতাদের ভাষায়, “দেশের সর্বোচ্চ মেধাবীরা যদি তাদের প্রাপ্য মর্যাদা না-ই পান, তবে দেশের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা ধ্বংস হবে। সরকার যদি এখনই পদক্ষেপ না নেয়, তবে বাংলাদেশে আর প্রকৃত অর্থে ‘Engineer’ শব্দটির কোনো মানে থাকবে না।”