বিধবার জমি দখলের অভিযোগ জিপিএইচ ইস্পাতের বিরুদ্ধে

অসহায় বিধবা মহিলার ৭৮ শতাংশ জমি জোরপূর্বক দখলের অভিযোগ উঠেছে জিপিএইচ ইস্পাত লিমিটেডের বিরুদ্ধে। চট্টগ্রাম চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দায়েকৃত ওই মামলায় সীতাকুন্ড থাকার ওসিকে তদন্তের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

গত ১০ নভেম্বর মামলাটি দায়ের করেছেন সীতাকুন্ড থানার দক্ষিণ বাঁশবাড়িয়া গ্রামের মৃত নুরুন্নবীর স্ত্রী আনোয়ারা বেগম। এতে জিপিএইচ ইস্পাত লিমিটেডের কর্মকর্তা আশরাফুল আলম, জাহাঙ্গীর আলম ও আলমাছ শিমুলকে আসামি করা হয়েছে।

বিধবা আনোয়ারা বেগম বলেন, জিপিএইচ ইস্পাত আমাদের ৭৮ শতাংশ জমি জোরপূর্বক দখল করে স্থাপনা নির্মাণসহ অন্যান্য উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। জমি দখলে বাধা দিতে গেলে ওই জমি তারা কিনে নিয়েছে বলে দাবি করেন। দলিল সম্পর্কে জানতে চাইলে আসামিগণ সকলে ক্ষিপ্ত হয়ে মারপিট করেন। পরবর্তীতে বেশি বাড়াবাড়ি করলে চাঁদাবাজি মামলা দিয়া জেল হাজতে ঢুকাইয়া দিবে, অপরহরণসহ খুন ও গুম করবে মর্মে হুমকি দিয়েছে।

তিনি বলেন, আমারা কখনও ওই জমি বিক্রি করি নাই। এমনকি আমার শাশুড়ি কখনও জমি বিক্রি করেন নাই। আমরা চরম আতঙ্কের মধ্যে দিন পার করছি। আসামিরা হেন অপকর্ম নেই যা করতে পারে না। তারা স্থানীয় অনেকের বিরুদ্ধে বহু মিথ্যা মামলা দায়ের করে হয়রানি করছে। অনেককে এলাকা ছাড়া করেছে। একইভাবে আমাদেরকেও হয়রানি করতে পারে।

মামলার এজাহারে লেখা হয়েছে, আসামিদের বিরুদ্ধে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে অনেক অভিযোগ রয়েছে। তারা এলাকার নিরীহ হাজার হাজার স্থানীয় মানুষকে পানিবন্দী করে গৃহহীন করেছে। সরকারের বিভিন্ন দপ্তর এসব বিষয়ে অবগত। আসামিগণ বিগত ফ্যাসিবাদ সরকারের দোসর হিসেবে পরিচিতি থাকায় তখন তারা কোন আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন নাই।

বিধবা আনোয়ারা বেগমের এ কথার প্রমান পাওয়া যায়, পিবিআই ও সিআইডির প্রতিবেদনে। সিআইডির (ক্রিমিনাল ইনভেস্টিশেন ডিপার্টমেন্ট) রিপোর্টে বলছে, রাগ ও ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে আবু বক্কর চৌধুরীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করেছে জিপিএইচ ইস্পাত লিমিটেড। আবু বক্কর চৌধুরীকে বিতর্কিত করার মাধ্যমে ঘায়েল করায় ছিল মূল উদ্দেশ্যে।

জিপিএইচ ইস্পাত লিমিটেডের দায়েরকৃত মামলার প্রতিবেদনে এমন মন্তব্য করেছেন সিআইডি উপ-পুলিশ পরিদর্শক রাশেদুল ইসলাম। ২০২৪ সালের ৬ জুন রিপোর্টটি দাখিল করেন তিনি। প্রতিবাদী কণ্ঠ দমাতে জিপিএইচ ইস্পাত লিমিটেডের মিথ্যা মামলা বাণিজ্যের আংশিক চিত্র উঠে এসেছে ওই রিপোর্টে।

বাস্তবতা আরও অনেক ভয়াবহ, অনেকেই ফেরারী জীবন যাপন করছেন জিপিএইচ ইস্পাতের লেলিয়ে দেওয়া সন্ত্রাসীদের কারণে। মামলা-হামলা ও হয়রানির মাধ্যমে পুরো দাশপাড়া জবর দখল করেছে কোম্পানিটি। আবার অনেকে হুমকি-ধামকি ও অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে নিজেকে সপে দিয়েছে জিপিএইচ ইস্পাত লিমিটেডের কাছে।

জিপিএইচ ইস্পাত লিমিটেডের কর্মকর্তা মোহাম্মদ সেলিম (ঋণ সমন্বয় এবং পর্যবেক্ষণ বিভাগ) বাদী হয়ে বহুল আলোচিত ওই চাঁদাবাজির মামলাটি (সিআর ৫২৬/২০২২) দায়ের করেন। প্রথম তদন্ত করে ‍পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) উপ-পুলিশ পরিদর্শক মোঃ কামাল আব্বাস। মামলা সাক্ষ্য প্রমাণে সত্য প্রমাণিত না হওয়ায় ২০২৩ সালের ২০ মে তারিখে চুড়ান্ত রিপোর্ট প্রদান করেন তিনি। এতে ক্ষিপ্ত জিপিএইচ ইস্পাত না-রাজি দরখাস্ত দাখিল করেন। দ্বিতীয় দফায় তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় সিআইডিকে। সে রিপোর্টে জিপিএইচ ইস্পাতের কিছুটা স্বরূপ তুলে এনেছেন সিআইডি সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তা রাশেদুল ইসলাম।

তিনি লিখেছেন, মামলার তদন্তকালে জানা যায়, অনুমান ২০/২৫ বছর পুর্বে চট্টগ্রামের কুমিরা এলাকায় জিপিএইচ ইস্পাত ফ্যাক্টরি স্থাপিত হয়। পুর্বে ফ্যাক্টরির পরিসর ছোট থাকলেও ৪/৫ বছর যাবত কারখানার পরিসর বড় করা হয়। এ সময় জিপিএইচ ইস্পাত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশ ঘেষে বয়ে চলা অনুমান ৪০/৪৫ ফুট চওড়া ছোট খাল দখল করে ভরাট করায় উক্ত খাল দিয়ে পানি এবং বর্জ্য অপসারণ বাধাগ্রস্ত হয়। পরবর্তীতে আরও কয়েকটি কোম্পানি খাল দখল করে ভরাট করায় আশ পাশের এলাকার পানি ও বর্জ্য অপসারণ চূড়ান্ত রূপে বাধাগ্রস্ত হয়। যার ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই আশে পাশের এলাকায় প্রায় ৪০০ পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়ে। আশে পাশের স্কুল, মসজিদ, মন্দির, বাজার পানিতে নিমজ্জিত হয়ে জনজীবনে দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়। এই বিষয়ে স্থানীয় লোকজন মানববন্ধন, গণস্বাক্ষর কার্যক্রম পরিচালনা করে প্রতিবাদ জানায় আবু বক্কর চৌধুরী।

তদন্তকালে আরও জানা যায়, অত্র মামলার বিবাদী আবু বক্কর চৌধুরী (৫৫) বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন, সীতাকুন্ড উপজেলা শাখার সভাপতি হিসেবে রাস্তার পাশের খাল অবৈধ দখল থেকে উদ্ধার, বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য যত্রতত্র ফেলার কারণে পরিবেশ দুষণ, কালভাটের মুখ বন্ধ করতঃ পানি নিষ্কাষণ সংক্রান্ত অধিকার ক্ষতিগ্রস্ত, কোটি কোটি টাকার সরকারি রাস্তা, পাহাড়ী ছড়া ভরাট নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ করেন। একইসঙ্গে জনগণের কল্যাণার্থে উল্লেখিত বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কার্যালয়, সওজ, জেলা প্রশাসক, উপজেলা পরিষদে লিখিত অভিযোগ দায়ের কারনে। জনস্বার্থে দায়েরকৃত অভিযোগের প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরসমুহ ঘটনাস্থল সরেজমিন পরিদর্শন করে ভুক্তভোগী লোকজনের বিবৃতি গ্রহণ করেন এবং বিদ্যমান সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

মামলা বিবাদী স্থানীয় মানুষদের দুর্ভোগ লাঘব করার জন্য বিভিন্ন দপ্তরে পত্র প্রেরণসহ বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের জলাবদ্ধতার জনদূর্ভোগের বিষয়ে লিখিতভাবে জানান। বিবাদীর লিখিত অভিযোগের প্রেক্ষিতে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম সংশ্লিষ্ট এলাকার জলাবদ্ধতার খবর প্রচার করে। উল্লেখিত কারণে জিপিএইচ ইস্পাত লিমিটেড বিবাদীর প্রতি ক্ষুব্ধ হয়। তৎপ্রেক্ষিতে রাগ ও ক্ষোভের বশবতী হয়ে জিপিএইচ ইস্পাত তার কর্মকর্তাকে মামলা করার দায়িত্ব প্রদান করে। বিবাদীকে বিতর্কিত করার জন্য মামলা দায়ের করেছেন। মামলার বাদীর আর্জিতে আনিত অভিযোগের বিষয়ে কোন সাক্ষ্য প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেন নাই।

অনেক চেষ্টা করেও জিপিএইচ ইস্পাত লিমিটেডের কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি। কারখানার গেটে গেলেও কেউ কথা বলতে রাজি হননি। জিপিএইচ ইস্পাতের মিডিয়া অ্যাডভাইজার অভীক ওসমানের সঙ্গে একাধিক দফায় যোগাযোগ হলে কোন বক্তব্য দেননি। তিনি বলেছেন, কোম্পানি প্রয়োজন মনে করলে প্রতিক্রিয়া জানাবে।

পাঠকের মন্তব্য