নরসিংদী-৪: বকুলকে নিয়ে বিতর্ক- তৎপর জুয়েল
-
- - নিজস্ব -
- প্রতিবেদক --
- ১২ নভেম্বর, ২০২৫
নরসিংদী-৪ (মনোহরদী–বেলাব) আসনটি রাজনৈতিকভাবে বরাবরই আলোচিত। দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের আধিপত্য থাকা এই আসনে বিএনপি বিভিন্ন সময় নতুন কৌশল নিয়ে মাঠে নেমেছে, তবে সাংগঠনিক দুর্বলতা, মামলা–হামলার চাপ এবং নির্বাচনসংক্রান্ত প্রতিকূলতার কারণে কাঙ্ক্ষিত গতি পায়নি। এমন বাস্তবতায় এবারের মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় আব্দুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েল বঞ্চিত হওয়া স্থানীয় বিএনপি রাজনীতিতে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
দীর্ঘদিনের ত্যাগী নেতা, তবু মনোনয়নের বাইরে:
ওয়ান–ইলেভেন পরবর্তী দুই দশকে নরসিংদী-৪ এ বিএনপির কর্মসূচি, আন্দোলন এবং সাংগঠনিক অবস্থানে যে কজন নেতা সাহসী ভূমিকায় সামনে ছিলেন, জুয়েল তাদের অন্যতম। রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিতে গিয়ে তার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলার সংখ্যা ১৬০টিরও বেশি। আন্দোলন চলাকালে দফায় দফায় কারাবরণ করেছেন; সব মিলিয়ে দুই বছরের বেশি সময় কারাগারে কাটিয়েছেন। বিভিন্ন মামলায় মোট ১৭ বছরের সাজাপ্রাপ্তির বিষয়টি তাকে এলাকার সবচেয়ে ত্যাগী নেতায় পরিণত করেছে। বিএনপির দুঃসময়ে সংগঠন ধরে রাখা, কর্মীদের সক্রিয় রাখা এবং কেন্দ্রীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে তিনি দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন—এমন মন্তব্য পাওয়া যায় তার সহকর্মী ও সমর্থকদের কাছ থেকে।
তবে এত ত্যাগ–অবদান থাকা সত্ত্বেও জুয়েল এবার মনোনয়ন তালিকায় জায়গা পাননি। প্রার্থী ঘোষণার পর স্থানীয় বিএনপি মহলে হতাশা ও প্রশ্নের সুর শোনা গেছে—কেন মাঠে থাকা নেতার প্রতি আস্থা দেখানো হলো না?
কি বলছে বিএনপির কেন্দ্রীয় এবং জেলা পর্যায়ের নেতারা?
এটি চূড়ান্ত মনোনয়ন নয়, বলছে বিএনপি'র কেন্দ্রীয় এবং জেলা পর্যায়ের নেতারা।
বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক নেতার বক্তব্য অনুযায়ী- এটি একটি সম্ভাব্য তালিকা মাত্র, চূড়ান্ত কিছু নয়। প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বিএনপি যেসব জরিপ পরিচালনা করেছে, অনেকটা তার উপর ভিত্তি করেই প্রাথমিক তালিকা তৈরী করা হয়েছে। তবে, জরিপ পদ্ধতি এবং জরিপকে প্রভাবিত করার মতো কিছু অভিযোগ উঠায়, নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান দিয়ে অধিকতর যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। সে প্রেক্ষিতে চূড়ান্ত তালিকায় কিছু প্রার্থী পরিবর্তনের জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে।
সংগঠনে প্রভাব—কর্মীদের মনোবল কি কমবে?
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, বিএনপির বড় চ্যালেঞ্জ সাংগঠনিক ঐক্য বজায় রাখা। নরসিংদী-৪ এ আওয়ামী লীগের বহু বছরের প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা এবং প্রশাসনিক শক্তি বিএনপির জন্য বড় বাধা। এমন সময়ে ত্যাগী নেতাদের মনোবল কমে গেলে বা কর্মীরা সংগঠন থেকে দূরে সরে গেলে নির্বাচনী মাঠ দুর্বল হয়ে পড়ে।
স্থানীয় নেতা–কর্মীদের কথায় বারবার উঠে আসে—“দুঃসময়ে যারা ছিল, সে নেতাদের মূল্যায়ন না হলে সংগঠনে হতাশা বেড়ে যায়।” জুয়েলের নেতৃত্বে মাঠে থাকা অনেক তরুণ কর্মী এবার মনোনয়ন বঞ্চনার কারণে মানসিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত। তারা মনে করেন, দলের প্রতি অগাধ আনুগত্য ও ত্যাগ থাকা সত্ত্বেও সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ায় তাদের নেতাকে যথাযথভাবে বিবেচনা করা হয়নি।
জুয়েলের প্রতিক্রিয়া—নীরবতা ও শৃঙ্খলার বার্তা:
এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো মন্তব্য না করলেও জুয়েলের ঘনিষ্ঠদের দাবি—তিনি দলীয় সিদ্ধান্তকে সম্মান করেন এবং আগের মতোই দলের সঙ্গে থাকবেন। বরাবরের মতোই তিনি দলকে নিয়ে কোন বিতর্ক চান না। বরং নেতা–কর্মীদের আগের মতোই মাঠে থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন। তার এই অবস্থানকে অনেকেই “সংগঠনের প্রতি আনুগত্যের উদাহরণ” মনে করছেন।
প্রাথমিকভাবে মনোনীত প্রার্থী নিয়ে বিতর্ক:
অপরদিকে মনোনয়নের প্রাথমিক তালিকায় যিনি রয়েছেন সরদার মো: সাখাওয়াত হোসেন বকুল, যিনি ১/১১ মান্নান ভূইয়ার সহযোগী হিসেবে দল ভাঙ্গার চেষ্টা করেছেন এবং এ কারণে দলে তিনি সংস্কারপন্থী নেতা হিসেবে পরিচিত। এছাড়াও বিগত ১৭ বছরে মাঠের আন্দোলনে মনোহরদী-বেলাবতে উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা রাখতে দেখা যায়নি এই প্রার্থীকে। বরঞ্চ এই আসনের আওয়ামী লীগের মন্ত্রী উনার আত্মীয় হওয়ার কারণে লিয়াজো করে মাঠের আন্দোলনে নিস্ক্রিয় থাকার অভিযোগে বিএনপির অনেক নেতা-কর্মীই উনার প্রতি অসন্তুষ্ট বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এরমধ্যে গুরুতর অভিযোগ হলো, ২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী প্রার্থীর পক্ষে বিএনপির লোকজনকে ভোট দিতে বাধ্য করার অভিযোগ্ও রয়েছে।
কার জনপ্রিয়তা কেমন: তরুণদের কাছে জুয়েল এগিয়ে, বকুল নিয়ে মিশ্র মত
নরসিংদী-৪ আসনে তরুণদের মধ্যে আব্দুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েলকে তুলনামূলকভাবে বেশি গ্রহণযোগ্য হিসেবে দেখা যায়। ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি থাকাকালে আন্দোলন ও সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে তার সক্রিয় অংশগ্রহণ অনেক তরুণের মধ্যে ইতিবাচক ধারণা তৈরি করেছে। অন্যদিকে সরদার মো. সাখাওয়াত হোসেন বকুলের সঙ্গে এলাকাবাসীর, বিশেষ করে তরুণ ভোটারদের যোগাযোগ তুলনামূলকভাবে কম বলে স্থানীয় সূত্র জানায়। তবে তার অভিজ্ঞতা ও রাজনৈতিক পরিচিতিকে অনেকেই এখনও মূল্যায়নের যোগ্য মনে করেন। সাজেদুল ইসলাম নামে এক তরুণ ভোটার বলেন-" সাখাওয়াত হোসেন বকুল গত আন্দোলন সংগ্রামে রাজপথে ছিলেন না, আওয়ামী এক মন্ত্রীর আত্মীয় হওয়ার কারণে তাকে কোন নির্যাতন কিংবা জেল মামলা সহ্য করতে হয়নি"।
আগামী নির্বাচন—ঐক্যই প্রধান শক্তি:
বিশ্লেষকেরা বলছেন, নরসিংদী-৪ এ বিএনপির সফলতার প্রধান শর্ত হচ্ছে ত্যাগী ও নতুন নেতৃত্বের সমন্বয়। মনোনয়ন পাওয়া নেতা যদি বঞ্চিত নেতাদের সঙ্গে নিয়ে মাঠে নামতে পারেন, তবে বিএনপি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শক্ত অবস্থান নিতে পারে। অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ বাড়লে বা মাঠপর্যায়ে নিষ্ক্রিয়তা দেখা দিলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা আরও কঠিন হয়ে পড়বে।
সব মিলিয়ে, জুয়েলের মনোনয়ন বঞ্চনা স্থানীয় বিএনপির সাংগঠনিক বাস্তবতা, কেন্দ্রীয় মূল্যায়ন প্রক্রিয়া এবং আগামী নির্বাচনের সম্ভাব্য অবস্থান—সবকিছুকে নতুন করে আলোচনায় এনেছে।
এই আলোচনা কতটা গঠনমূলক হবে এবং এটি সংগঠনকে কতটা ঐক্যবদ্ধ করতে সাহায্য করবে—এটাই এখন পর্যবেক্ষণের বিষয়।