ব্যাংক বিসিএস অন্যান্য পরীক্ষা মিলিয়ে ৪২ টা প্রিলি ফেইল, অবশেষে বিসিএস ক্যাডার

সফলতার গল্প বলার আগে আপনাদের সাথে কিছু ব্যার্থতার গল্প বলে নেই। উদ্দেশ্য নিজেকে বিশেষ কিছু প্রমাণ করা নয়,জাস্ট মোটিভেট করা। অন্ত্যত একজন জুনিয়র মোটিভেট হলেও ভাল লাগবে।বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করে অনার্সের সার্টিফিকেট পাই ২০১৪ সালে।তখনও ভাবতে পারিনি সামনে কি সময় অপেক্ষা করছে আমার জন্য।প্রথম দিকে যখনই কোন চাকরির সার্কুলার দিত তখনই স্বপ্ন দেখতাম ঐ প্রতিষ্ঠানে জব পেয়ে গেছি।আর বিসিএসএর ব্যাপারে ছিল দারুণ ক্রেজ।কোন বিসিএস ক্যাডার ভাইয়ের সাথে সরাসরি কথা বলার সৌভাগ্য ছিলনা, সুতরাং বিসিএস সম্পর্কে অনেক কিছুই অজানা ছিল। আমার মনে আছে তখন আমি বেতন স্কেলই বুঝতামনা। মনে করতাম বিসিএস ক্যাডারদের বেতন মনে হয় ৫০-৬০ হাজার টাকা। 

বাকৃবির এক বন্ধুর সাথে সবসময় বিসিএস নিয়ে আলোচনা করতাম, কিন্তু তখন হলে না থাকায় আমাদের গাইড দেয়ার মত কেউ ছিলনা। যাইহোক এমন সময় নতুন সিলেবাসে ৩৫ তম বিসিএস এর সার্কুলার দিল।ফেসবুকে তখন ততটা এক্টিভ না থাকায় ক্যাডার চয়েজ সম্পর্কে কোন ধারণা ছিলনা। তবে এটুকু বুঝতাম বোথ ক্যাডারে এপ্লাই করতে হবে, তাতে জেনারেল না পেলে টেকনিক্যাল ক্যাডার পাব। যাই হোক ৩৫ এ আবেদনের পর হলে উঠে পড়তে শুরু করি। আমার মনে আছে এমনও সময় গিয়েছে আমার রুমমেট রাতে ঘুমানোর আগে দেখত আমি পড়তেছি,সকালে ঘুম থেকে উঠেও দেখত আমি পড়তেছি। মানে ঘুমাতাম সবার শেষে,উঠতাম সবার আগে। 

কিন্তু কতটা ফ্র্যুটলেস ছিল পড়াগুলো তখন বুঝতে পারি যখন ৩৫ এর প্রিলিতে ৬০ মার্কসও উঠেনি, সেবার কাটমার্ক ছিল ৮৮ -৯০ । এরপর আবার শুরু করলাম, তখন ফেসবুকে একটু একটু এক্টিভ হলাম, সুশান্ত পাল, মাশরুফ হোসেন ভাইদের কিছু পোস্ট পড়ে মোটিভেট হতাম। ৩৬ এর প্রিলির সময় প্রচুর পড়লাম, কিন্তু প্রিলিতে মার্ক উঠলো ১০৪ এর মত। মোটামুটি আশা করছিলাম প্রিলি টিকব। রেজাল্ট হলো ফেইল আসলো আবার। কনফিউশন প্রশ্নগুলো ভুল করায় মার্ক ৯৫ এর মত হয়ে গিয়েছিল, সেবার কাটমার্ক ছিল ১০৫-৬ এর মত। ৩৬ এর প্রিলির ধাক্কাটা ছিল খুব বড় রকমের। ততদিনে আমার মাস্টার্স শেষ হওয়ায় হল ছেড়ে দিতে হল, বাসায় একা হয়ে গেলাম, এলাকা বা ক্যাম্পাসেও কোন বন্ধু নেই। এমনও দিন গেছে ১০-১৫ দিন পরিবার ছাড়া কারও সাথে কথা হয়েছে। 

এরমাঝে হিসেব করে দেখলাম ব্যাংক বিসিএস আর অন্যান্য পরীক্ষা মিলিয়ে ৪২ টা প্রিলি ফেইল। টেবিলের নিচে এডমিটকার্ডের স্তুপ জমে গেছে। ভীষণ হতাশা ঘিরে ধরল মনে। আমার মনে আছে এসময় ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্যাশ অফিসারের পরীক্ষা দিয়ে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহে ফিরছি।পরীক্ষা যথারীতি খারাপ হওয়ায় মন খারাপ। মাঝখানে এক স্টপেজে বাকৃবির এক বড় ভাইয়ের সাথে দেখা, ভাই ৩ টা বিসিএসএর ভাইভা দিয়েছে। ভাইকে হতাশার কথা বললাম। ভাইয়ের একটা কথা আমাকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। "চাকরির পরীক্ষায় কেউ ৫ম পরীক্ষায় চাকরি হয়ে যাবে আবার কারো ৫০ তম পরীক্ষায় হবে, তাই বলে যার ৫০ তম তে হবে সে যদি ৪৯ তমতে ব্যার্থ হয়ে হাল ছেড়ে দেয় তাহলে তো সে চাকরিটা পাবেনা, আরো কিছুদিন লেগে থাকো ভাইয়া"। লেগে থাকো ভাইয়া,এই কথাটা খুব মনে ধরেছিল।

তার কয়েকদিন পর বিকেলে হাটতে হাটতে বাকৃবি ক্যাম্পাসে যাই। ক্যাম্পাসের এক বড়ভাই ডাক দিলেন, ভাইও বিসিএসএস প্রিপারেশন নিচ্ছেন। ভাইকে বললাম, ভাই অনেক মোটিভেশনাল কথা বললেন। এবং শেষ পর্যন্ত বললেন কোন একটা কোচিংয়ে ভর্তি হয়ে এক্সাম দে। ভাইয়ের কথামত কোচিংয়ে ভর্তি হতে চাইলাম, ৪২০০ টাকা লাগে, বাসায় চাইলে বলল এমাসে নয় পরের মাসে দিতে পারবে।

গার্লফ্রেন্ডকে বললাম, সে নিজের জন্য শাড়ী কেনার জন্য বাসা থেকে টাকা নিয়েছিল। ওখান থেকে অর্ধেক আমাকে দিয়েছিল। কোচিংয়ে এক্সাম ব্যাচে ভর্তি হলাম। এমন সময় Bcs our goal গ্রুপেও এড হলাম।গ্রুপে খুব এক্টিভ ছিলাম, ভাল লাগত খুব। আবার পড়াশোনা শুরু করলাম, কোচিংয়ের লাইব্রেরীতে যেতাম আর রাতে বাসায় পড়তাম। সেপ্টেম্বরে ৩৭ এর প্রিলি হলো। টিকে গেলাম, আলহামদুলিল্লাহ। ২.৫ বছরের চেষ্টায় ৪৬ টা পরীক্ষার পর অবশেষে প্রিলি পাশ। 
 
এরপর বেশকিছুদিন কনফিডেন্স তুঙ্গে ছিল, যে পরীক্ষা দিতাম সেটাই টিকে যেতাম। এমন সময় চাকরিও হয়ে যায় পূবালি ব্যাংকে TAJO(Cash)পদে। প্রথম চাকরি, আবেগ অনেক বেশি। এমন সময় ৩৭ এর লিখিতও পাশ করলাম। ভাইভা ছিল জানুয়ারিতে। আমি ৩.৫ মাসের চাকরিজীবনে ২ জন ম্যানেজার পাই।আমার প্রথম  ম্যানেজার স্যার ছিলেন হেল্পফুল। ভাইভা দিব আর ৩৮ এর প্রিলি দিব শুনে আমাকে পড়াশোনা করতে উৎসাহ দিতেন, আমি নিজেও ব্যাংকে বই নিয়ে যেতাম, যখন কাস্টমার থাকতনা পড়তাম। ভাইভার আগে আগে স্যার বদলি হয়ে যান, যাওয়ার আগে আমাকে ভাইভার জন্য ছুটি দিতে ভারপ্রাপ্ত ম্যানেজারকে অনুরোধ করেন এবং ব্রাঞ্চের বাকিস্টাফদের আমাকে সহযোগিতা করতে বলেন। ভাইভার ৩ দিন আগে ছুটি নিয়ে আমি ঢাকায় চলে আসি, এমন সময় নতুন ম্যানেজার আমার ছুটি বাতিল করে দেয়। অফিস করতে বলেন। মনটাই খারাপ হয়ে যায়, ভাইভা দিলাম ব্রাঞ্চে আনঅথোরাইজড এবসেন্ট হিসেবে।

ফিরে এসে পানিশমেন্ট হিসেবে ট্রান্সফার অর্ডার পাই। মেজাজ হারিয়ে চাকরি ছেড়ে দেই। তখনও বিশ্বাস ছিল খুব দ্রুত আরেকটা চাকরি পাব। ৩ মাস পর রেজাল্ট দিল ৩৭ এর, নন-ক্যাডার, মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মত ব্যাপার হয় যখন একটা ব্যাংকের ভাইভাতেও রোল না আসে। চরম অনিশ্চয়তার মাঝে দিন কাটত। প্রচন্ড ডিপ্রেশনে পড়ে গেলাম। রাতে চোখ দিয়ে এমনিতেই পানি পড়ত। আমাদের দেশে ডিপ্রেশনকে কোন পাত্তা দেয়া হয়না, বাসায় কোন সাপোর্ট পেলামনা এ ব্যাপারে।

শেষপর্যন্ত হাসপাতালের আউটডোরে ডাক্তার দেখালাম, আমার ডিপ্রেশনের মাত্রা এত ছিল যে ডাক্তাররা পর্যন্ত বিষ্মিত হন। বিশেষজ্ঞ বড় ডাক্তারের কাছে রেফার করেন সাথে সাইকোথেরাপি কাউন্সেলিং। সেসময় গার্লফ্রেন্ডের কাছ থেকে টাকা নিয়ে সাইকোথেরাপি আর কাউন্সেলিংয়ের খরচ নিতাম, বাসা থেকেও নিতাম, চাকরি ছাড়ার পর মানুষের ডিপ্রেশন লেভেল কেমন হয় আমি বুঝেছি তখন। এমন সময় ৩৮ লিখিত দিই। ব্যাংকে নতুনকরে পরীক্ষা দেয়া শুরু করলাম। ম্যাথ তেমন পারিনা বলে সবগুলো প্রিলি পাস হলেও রিটেন ফেল করলাম প্রায় ২২ টা। মনের অবস্থা খুব খারাপ, গার্লফ্রেন্ডের বাসা থেকে চাপ, আমারও কোন জব হচ্ছেনা। এসময়টা আমি পার করতে পারতামনা যদি না আমি ধর্মের প্রতি আর নামাজের প্রতি ঝুকে না পড়তাম।আমার সব কষ্টের কথা আল্লাহকে বলতাম, কোরআন পড়তাম, কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে মোটিভেট হতাম।

একসময় আল্লাহ রহমত করলেন,৩৭ তম বিসিএস নন-ক্যাডার থেকে সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা পদে সুপারিশ পেলাম ২০১৯ এর অক্টোরে। এক মাস পর সোনালি ব্যাংকের অফিসারেও হয়ে গেল,তার একমাস পর বিকেবি অফিসারের প্যানেল থেকে। দীর্ঘ ৬ বছর কষ্টের প্রতিদান পেলাম। সব দূঃখ ভুলে গেলাম। মার্চে সোনালি ব্যাংক আর কৃষি ব্যাংকে জয়েনিং ছিল। নন-ক্যাডার সহকারি রাজস্ব কর্মকর্তায় তখনো গেজেট হয়নি, সোনালি তে জয়েন করার কথা ছিল যতদিন না এআরওর গেজেট হয়। এমন সময় মনে হলো আমি যদি কয়েকমাসের জন্য ব্যাংকে জয়েন করি তাহলে তো প্যানেল থেকে সেই পদে আর কাউকে নিবেনা।

একটা পোস্ট নষ্ট হবে আর একজনের ৩০ বছরের রুজি নষ্ট হবে।থাক জয়েন করবনা, এতদিন যেহেতু কষ্ট করেছি আর কিছুদিন করি। এআরওতে এখনও জয়েন হয়নি, অনকে বলে ব্যাংকে জয়েন করলেই পারতে, বাসা থেকেও মন খারাপ করে, করোনার জন্য গতমাসে সোনালিতে জয়েন করার আবার সুযোগ এসেছিল। বাসার চাপ ছিল জয়েন করতে,তারপরও করিনি। আল্লাহর উপর ভরসা রেখেছি, একজনের রুজি কোনভাবেই নষ্ট করিনি। আলহামদুলিল্লাহ গত মঙ্গলবার ৩৮ এর রেজাল্টে কৃষি ক্যাডারে সুপারিশ পাই। আমার ব্যার্থতার পাল্লা বেশি ভারী ছিল,৬.৫ বছরের চেষ্টায় মাত্র ৭ টা ভাইভা দিয়েছি। কিন্তু আল্লাহ আমাকে এত দিয়েছেন যে আমি সারাজীবন শুকরিয়া জানিয়েও শেষ করতে পারবনা। ৭ টা ভাইবায় মোট চাকরি হলো ৫ টা। গল্পটা বললাম একারণে যে কখনো হতাশ হওয়া যাবেনা। লেগে থাকলে ভাল কিছু হবেই।

বিঃদ্রঃআমি আমার জুনিয়রদের সবসময় মোটিভেট করি।ফেসবুকে সবার  টেক্সটের জবাব দেই একারণে যে কেউ যেন আমার মত গাইডলাইন ছাড়া পড়াশোনা না করেন। আমি যে অভাব বোধ করেছি, আমার জুনিয়ররাও সেটা বোধ করুক আমি তা চাইনা। হয়ত অনেকসময় সাথে সাথে রিপ্লাই পাবেনা, কিন্তু কখনো কোন জুনিয়র বলবে আনোয়ার ভাই রিপ্লাই দেয়না বা হেল্প করেনা সেটা আমি পছন্দ করিনা। হেল্প লাগলে ইনবক্স সবসময় খোলা।ধন্যবাদ।

পাঠকের মন্তব্য